ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

‘বৃক্ষনিধন ও পাথর আহরণ’ পাহাড় ধসের কারণ

Photo 16.06.17 (1)মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, লামা (বান্দরবান) প্রতিনিধি ঃ
সাম্প্রতিক পাহাড় ধসে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনার পর আতঙ্কে ভর করেছে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকৃত জনগণের মধ্যে। ঝুঁকিতে বসবাস করা লোকজন জানায়, বিকল্প কোন যাওয়ার জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়েই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে বসবাস করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তাদের সরিয়ে নেওয়ার সু-নিদিষ্ট কোনো উদ্যোগ নেই। বর্ষা মৌসুমে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেই টনক নড়ে প্রশাসনের। কিন্তু পরে এসব বিষয় নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না এমনটা অভিযোগ স্থানীয়দের।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে শুধুমাত্র বান্দরবান শহরের আশে পাশে পাঁচ হাজারেও বেশি পরিবার পাহাড় কেটে বা পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। এছাড়া জেলার লামা, আলীকদম, রুমা, নাইক্ষ্যংছড়ি ও থানচিসহ বিভিন্ন জায়গাতেও একই অবস্থা।
উদ্বেগের বিষয় হল প্রশাসনের কাছে ঝুকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের কোনো তালিকা নেই। ফলে দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে তেমন কোনো উদ্যোগই নেওয়া সম্ভব হয় না। জেলা প্রশাসনের ত্রাণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে বান্দরবানে পাহাড় ধসের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৬০ জনের। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৩৭ জন, ২০১৩ সালে ১ জন, ২০১৪ সালে ৪ জন, ২০১৫ সালে ৯ জন এবং এই বছর ৯ জন।
প্রশাসনের এ হিসাব ছাড়াও দুর্গম এলাকার খবরগুলো সহজে পৌঁছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালে লামা উপজেলার ফাইতং আজিজনগর এলাকায় পাহাড় ধসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। প্রবল বর্ষণে ও পাহাড়ে গাছ থাকায় এসব এলাকার অধিকাংশ পাহাড়ই ধসে পরে। বান্দরবান শহরের কাছে ইসলামপুর এলাকায় পাহাড়ের ওপর গত পাঁচ বছর ধরে বসবাস করছেন দিনমজুর আহম্মদ উল্লাহ্। তার পাশে এখন অনেক ঘরই হয়েছে। কিন্তু Ÿৃষ্টি এলেই আতঙ্ক চাপে তার মনে। রাতে মৃত্যুর ভয়ে ঘুমাতে পারেন না। কখন মাথার ওপর পাহাড় ধসে পড়ে। তার মত একই অবস্থা বান্দরবানের হফেজ ঘোনা, বাস স্টেশন, লাঙ্গিপাড়া, কালা ঘাটা, বালা ঘাটাসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজনদের।
সম্প্রতি পাহাড় ধসের ঘটনা কেন বেড়েছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জেলা মৃত্তিকা সংরক্ষণ ও পানি বিভাজন কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহাবুবুর ইসলাম জানান, এমনিতেই পাহাড়গুলোতে গাছপালা কম। তার ওপর অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ, বৃক্ষ নিধন, পাথর উত্তোলন, জুম চাষ পাহাড়ের ব্যাপক ক্ষতি করছে। এছাড়া ঘন ঘন ভূমিকম্পের ফলে পাহাড়ে সৃষ্ট ফাটল দিয়ে পানি প্রবেশ করায় পাহাড়ের মাটির স্থায়িত্ব কমে যাচ্ছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই পাহাড় ধসে পড়ছে। তবে এখন থেকেই এসব বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া না হলে বিপর্যয় আরো বাড়বে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।
গত মঙ্গলবার ভোর রাতে বান্দরবান শহরের কাছে তিনটি স্থানে পাহাড় ধসে ৪ শিশুসহ ৬ জনের মৃত্যু হয়। পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে অধিকাংশ এলাকাতেই পাহাড়ে কোনো গাছপালা নেই। আছে কিছু লতাগুল্ম। মাটিগুলো নরম হয়ে পড়েছে।
জেলা শহরের কাছে লেমুঝিরি আমতল ঘোনা এলাকায় মাটিচাপা পড়ে নিহত হয় কৃষক আবদুল আজিজের ন্ত্রী ও মেয়ে। আজিজ ওই এলাকায় পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ করেছেন। পাহাড় ধসের ফলে তার ঘরটি গভীর মাটির নিচে চাপা পড়ে। ফলে দুদিন পর মাটির নিচ থেকে স্ত্রী ও মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়। একই অবস্থা ছিল কালাঘাটার কবরস্থান এলাকা ও লেমুঝিরি আগা পাড়ায়। যেসব এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে সব জায়গাতেই মাটি নরম হয়ে ধসে পড়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন এই পরিস্থিতিতে পাহাড়ের পাদদেশে বা পাহাড় কেটে যারা ঘরবাড়ি তৈরি করেছে তাদের পক্ষে বসবাস করা আরো কঠিন হয়ে পড়বে।

বান্দরবান পৌরসভার কাউন্সিলর অজিত দাশ জানান, বান্দরবানে নতুন বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এরা শহরে জায়গা না পেয়ে পাহাড়ের ঢালুতে বা পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করছে। এলাকায় রোহিঙ্গাদের বসবাসও বাড়ছে। সমতল জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়েই তারা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। বর্ষা আসলেই প্রাণহানির ঘটনাও বাড়ছে। পাহাড়ি এলাকা থেকে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হলেও কেউ সরে না।
লামার ফাইতং ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিনের সাথে কথা বলা হলে তিনি জানান, পাহাড়ে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষ নিম্ন আয়ের। তারা খাস জায়গায় পাহাড় কেটে ঘনবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করে। প্রবল বৃষ্টির সময় ছোট ছোট পাহাড়গুলোই বেশি ধসে পড়ে। তবে পাথুরে পাহাড়ে ধস খুবই কম হয়।
পাহাড় ধসে যাতে প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে সে জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুর্যোগকালীন মুহূর্তের জন্য এলাকায় নতুন নতুন আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ জরুরী বলে মনে করেন জনপ্রতিনিধিরা।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক সাংবাদিককে জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময় প্রাণহানি ঠেকাতে মাইকিং করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন জায়গাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে অভিযানও পরিচালনা করা হয়। মানুষের মাঝে সচেতনতা না আসলে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। তবে নতুন আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

পাঠকের মতামত: